ইসলাম: বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল ধর্ম ,বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম হিসেবে ইসলাম বর্তমানে প্রায় ২০০ কোটি অনুসারী নিয়ে সমগ্র বিশ্বের ২৪.৪ শতাংশ জনসংখ্যাকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
(সূত্র: ‘হোয়াই ইসলাম ইজ দ্য ওয়ার্ল্ড ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং রিলিজিয়ন’, পিউ রিসার্চ সেন্টার)
ইসলাম কি শুধুই একটি ধর্ম, না কি এটি একটি জীবনধারা, দর্শন কিংবা সংস্কৃতি? ইসলামের মূল শব্দটি আরবি, যা “সিলমুন” থেকে উৎপন্ন। কিছু অভিধানবিদের মতে, ইসলামের শাব্দিক অর্থ ‘শান্তি’ এবং ‘আত্মসমর্পণ’। (সূত্র: ‘হোয়াট ইসলাম ইজ অল অ্যাবাউট’, ইয়াসির ক্বাদি, অনুবাদ: আলী আহমদ মাবরুর)
এছাড়া, ইসলামের অর্থ আরও নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘অনুগত হওয়া’, ‘বিনম্রতা’, ‘নিরাপত্তা’, এবং ‘সমর্পণ’। শরিয়তের ভাষায়, ইসলাম হলো আল্লাহ্ তাআলার একত্বতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং তাঁর ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ। মুসলিমরা সেই সমস্ত ব্যক্তিরা, যারা এই জীবনবিধান অনুসরণ করে তাঁদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করেন। (সূত্র: ‘শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা’, পৃষ্ঠা ৯১)
ইসলামের দুটি মূল অঙ্গ হলো ‘ইমান’ ও ‘ইসলাম’। ইমান সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং ইসলাম সম্পর্কিত কর্মের মাধ্যমে এক ব্যক্তি তার জীবন পরিচালনা করেন। (সূত্র: ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’, খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর) মুহাম্মদ (সা.) এর নির্দেশিত আদর্শ ও বিধিবিধান অনুসরণ করাই ইসলামের প্রকৃত অর্থ। (সূত্র: ‘কাওয়াইদুল ফিকহ’, মুফতি আমীমুল এহসান, পৃষ্ঠা ১৭৭)
এভাবে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনধারা হিসেবে শুধু বিশ্বাসের উপর নয়, কর্মের মাধ্যমে এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, শান্তি এবং নিরাপত্তার দিকে মানুষকে পরিচালিত করে।আল্লাহ–তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘বলুন! আমার নামাজ, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও মরণ জগৎসমূহের মালিকের উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই। আর আমি এ জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২-১৬৩)
ইসলামের সংজ্ঞা বা পরিচয়ের বিষয়টি সবচেয়ে সহজভাবে বিখ্যাত হাদিসে জিব্রাইল থেকে পাওয়া যায়। হজরত জিব্রাইল (আ.) একবার মানুষের বেশে উপস্থিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ–তাআলা ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ বা ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল—এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, রমজান মানে রোজা রাখা এবং সামর্থ্যবানের জন্য হজ পালন করা, এটাই হলো ইসলাম।’ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তর শুনে জিব্রাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৮)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণনায় আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। স্তম্ভগুলো হলো—১. আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২. নামাজ কায়েম করা। ৩. জাকাত আদায় করা। ৪. রমজান মাসে রোজা রাখা এবং ৫. সামর্থ্য হলে হজ পালন করা। (মুসলিম, হাদিস: ১৬)
ইসলাম আল্লাহ–তাআলার পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া একমাত্র মনোনীত ও চূড়ান্ত বা পরিপূর্ণ ধর্ম। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম কেউ গ্রহণ করতে চাইলে তা কবুল বা গ্রহণযোগ্য হবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলাম আল্লাহ–তাআলা কর্তৃক মনোনীত একমাত্র দ্বীন বা ধর্ম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)
এ ব্যাপারে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৩)
প্রসিদ্ধ তাফসির–বিশারদ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এই আয়াত পবিত্র কোরআন নাজিলের শেষ দিককার আয়াত। এরপর বিধিবিধান–সম্পর্কিত আর কোনো আয়াত নাজিল হয়নি। হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে যে সত্য ধর্ম ও খোদায়ি নিয়ামতের অবতরণ ও প্রচলন শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক ভূখণ্ডের অবস্থা অনুযায়ী আদম সন্তানের মধ্যে নিয়ামত বণ্টনের যে ধারা অব্যাহত ছিল, আজ সে নিয়ামত ও ধর্ম পরিপূর্ণ আকারে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর উম্মতকে প্রদান করা হলো।’ (তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফী, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ৩০৯) পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল হবে না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫)
বস্তুত ইসলাম সব নবী-রাসুলের অভিন্ন ধর্ম। প্রথম নবী আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সবাই এ ধর্ম বা জীবনবিধানের দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৩) মোট কথা, আল্লাহর প্রেরিত সব নবী-রাসুলের প্রচারিত ধর্মে মৌলিকভাবে কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে প্রত্যেক নবী-রাসুলকে আলাদা বা ভিন্ন শরিয়ত দান করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ–তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৪৮)
হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম নিজ ধর্মকে ‘ইসলাম’ নামে এবং তাঁর অনুসারীদের ‘উম্মতে মুসলিমা’ নামকরণে অভিহিত করেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের মিল্লাত। তিনি আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৭৮)
ইসলাম হলো মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম, যা প্রকৃতিগতভাবে মানুষের জন্য নির্ধারিত জীবনবিধান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু স্বাভাবিকভাবে ইসলামের সহজাত ধর্মে জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান অথবা মুশরিক বানিয়ে দেয়।” (বুখারি, হাদিস: ১৩৫৮)
হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে, প্রতিটি যুগের নবী-রাসুলদের মাধ্যমে যে ইসলামী জীবনবিধান প্রচলিত ছিল, তা সর্বশেষ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি ছিলেন আল্লাহর শেষ নবী, আখেরি রাসুল। তাঁর আগমনের পর আর কোনো নবী বা রাসুল পৃথিবীতে আসবেন না। তাঁর মাধ্যমেই সকল পূর্ববর্তী নবী-রাসুলের শরিয়ত বা জীবনবিধান বাতিল হয়ে গেছে। তাই বর্তমান এবং ভবিষ্যতে, কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম বলতে যা বোঝানো হবে তা হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনীত জীবনবিধান এবং আদর্শ। (সূত্র: ‘দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম’, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৩৪)