এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, জনগণের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপাত, বাজার সিন্ডিকেট এবং সর্বশেষ ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে করের বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা নাভিশ্বাসে উঠেছে। যেখানে বর্তমান বাজারে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপে মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নিম্ন আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষের কথা সরকার কি চিন্তা করেছে? অনেক পণ্যে ও সেবায় আগে থেকেই উচ্চহারে কর রয়েছে। নতুন করে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে শতাধিক পণ্য ও সেবার দাম আরও বেড়ে গেল, যার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং সেবাও রয়েছে।
নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ শতাধিক পণ্য এবং সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বেড়ে গেল। যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা।
গত তিন বছর থেকে চলা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের ঘাড়ে নাভিশ্বাস ফেলছে। দেশে বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে এই কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। এটা সম্পূর্ণভাবে আইএমএফের শর্তের কাছে নতি স্বীকার এবং জনগণের সঙ্গে অবিচার। সরকার চাইলে আইএমএফের কাছে আরও সময় নিতে পারত; কিন্তু সরকার বেছে নিল ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত, যা সাধারণ মানুষকে অধিক চাপের মধ্যে ফেলবে এবং সামনে তা তাদের অসহিষ্ণুতাকেও বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে। সার্বিকভাবে বর্তমান সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনের ওপরও এই কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এজন্য সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে সরকারকে বিকল্প সমাধানগুলোর ওপর নজর দেওয়া উচিত। যেমন: বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা দুনিয়ার মধ্যেই অন্যতম কম। ওইসিডির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোয় যা ১৯ দশমিক ৯, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২৪ দশমিক ৭২ এবং উন্নত দেশগুলোয় ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশের কর আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে অবশ্যই; তবে কর আহরণ বৃদ্ধির জন্য ভ্যাট বৃদ্ধি করা যৌক্তিক সমাধান নয়, ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ করের আয়কর বৃদ্ধি করাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ কর আদায়ের ওপর বেশি নির্ভর করা হলে তা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি করে। যখন সরকারের আয়ের বেশির ভাগটা প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ কর অর্থাৎ আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বজনের কাছ থেকে আদায় করা হয়, তখন শ্রেণিভিত্তিক সম্পদ স্থানান্তরের ঘটনাটি ঘটে। বাংলাদেশে বিগত সরকারের আমলে ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ আয়করের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুল্ক ও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর বেশি আদায় করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
লক্ষণীয়, যেসব কারণে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বেকারত্ব।
বিগত সরকারের আমলের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ধনী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায় জোরদার করার বদলে আরও বেশি পরোক্ষ কর আদায়ের দিকে হাঁটছে। সরকার কর ফাঁকি রোধ ও বিদেশে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে জোর দেওয়ার বদলে অগণতান্ত্রিকভাবে আইএমএফের শর্ত মেনে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে তুলছে, যা মোটেও যৌক্তিক সমাধান নয় বরং এটি মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যাকে আরও দীর্ঘায়িত করবে এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলবে। আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মতো বৈষম্য সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ গ্রহণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্পিরিটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কাজেই সরকারকে ভ্যাটের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সহজ রাস্তা থেকে সরে আসতে হবে। ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বদলে ধনিক গোষ্ঠীর আয় ও সম্পদ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে। যদিও এ পদ্ধতি বেশ জটিল; কিন্তু জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে।
সংগীত কুমার
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়