গাজী আরমানঃ- রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র মাস। এই মাসের বিশেষত্ব হলো এটি রহমত, মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং নাজাত (জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি) লাভের মাস। সারা বছর আমরা যেমন বিভিন্ন ইবাদত করি, রমজান মাসে এসব ইবাদতের গুরুত্ব অনেক বেশি বেড়ে যায়। রমজান মাসে বিশেষ করে যে ইবাদতটি পালন করা হয়, তা হলো ‘সিয়াম’ বা রোজা রাখা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রাত জেগে ইবাদত করবে (তারাবিহ নামাজ পড়বে), তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ ‘যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মার্জনা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, খণ্ড: ১, হাদিস: ৩৭,৩৬ ও ৩৪)
অন্য একটি হাদিসে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়; শয়তানকে বন্দী করা হয়।’(বুখারি, খণ্ড: ৩, হাদিস: ১,৭৭৮)
রোজা বা সিয়াম:
‘সিয়াম’ শব্দটি আরবী, যার মানে হলো বিরত থাকা বা থেমে থাকা। সিয়াম বা রোজা আসলে ক্ষুধা, পিপাসা, খাওয়া–দাওয়া, খোলামেলা কথা বলা, খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম। ইসলামিক ক্যালেন্ডারের নবম মাস রমজানেই মুসলমানরা রোজা রাখে। রোজা রাখার মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর কাছ থেকে রহমত ও মাগফিরাত পাওয়ার চেষ্টা করেন। সিয়াম পালনকারীর জন্য রয়েছে জান্নাতে বিশেষ অভ্যর্থনা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে রায়্যান নামক একটি বিশেষ তোরণ আছে। এ তোরণ দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধু রোজাদারগণই প্রবেশ করবেন। তাঁদের প্রবেশের পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে, তাঁরা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি, খণ্ড: ৩, হাদিস: ১৭৭৫)
রোজা রাখার বিধি:
রমজান মাসের প্রতিটি দিনে ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখতে হয়। এর মানে হলো, সূর্য ওঠার আগে সেহরি খাওয়া হয় এবং সূর্যাস্তের পরই ইফতার করে রোজা ভাঙ্গা হয়। এই সময়ে খাওয়া–দাওয়া, পানীয় গ্রহণ, খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। তবে, যারা অসুস্থ, সফরে আছেন বা মহিলারা যদি মাসিক অবস্থায় থাকেন, তারা রোজা রাখতে বাধ্য নন। তারা পরবর্তীতে এসব দিনগুলোর রোজা রাখতে পারেন।এমন অক্ষম ব্যক্তি, যিনি পুনরায় সুস্থ হয়ে রোজা পালনের সামর্থ্য লাভের সম্ভাবনা নেই, তারা প্রতিটি রোজার জন্য একটি সদকাতুল ফিতরের সমপরিমাণ ফিদিয়া গরিব মিসকিনকে প্রদান করবেন। সক্ষম ব্যক্তি রোজা না রাখলে কঠিন গুনাহ হবে; এমতাবস্থায় তা কাজা আদায় করতে হবে। কিন্তু রোজা রাখার পর ওজর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে ফেললে কাজা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে। একটি রোজার কাজা হলো একটি রোজা এবং কাফফারা হলো একনাগাড়ে ৬০টি রোজা অথবা ৬০ মিসকিনকে দুই বেলা আহার করানো অথবা দাসমুক্ত করা।
রমজানের রহমত ও মাগফিরাত:
রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত ও মাগফিরাতের নিছে থাকেন। এই মাসে আল্লাহ তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেন এবং যারা জান্নাতে প্রবেশ করতে চান, তাদের জন্য এই মাস একটি বিশেষ সুযোগ। সেহরি ও ইফতারের সময়গুলোতে আল্লাহর কাছে দোয়া করা খুবই মূল্যবান এবং তা দ্রুত কবুল হয়। অতএব, মুসলমানদের জন্য রমজান মাস শুধু আত্মশুদ্ধি নয়, বরং আল্লাহর কাছ থেকে অশেষ রহমত লাভের সুযোগ। হাদিসে কুদসিতে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, “রোজা আমারই জন্য, আমিই এর বিনিময় প্রতিদান দেব।” ’‘রোজা আমারই জন্য, আমিই এর বিনিময় প্রতিদান হব।’ (বুখারি, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ২২৬)
রমজান মাসের শিক্ষা:
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অনেক বড় শিক্ষা দেয়। এই মাসে ক্ষুধা ও পিপাসা অনুভব করে গরিবদের কষ্টের কথা অনুভব করা যায়। এটি আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, ধৈর্য এবং আত্মসংযম শেখায়। রোজা রাখতে গিয়ে আমরা শিখি কীভাবে নিজেদের খারাপ অভ্যাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী হতে হয়। রমজান মাস শুধু একটি ইবাদত পালনের সময় নয়, এটি একটি আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মশুদ্ধির সময়। এই মাসে সিয়াম পালন করে আমরা আল্লাহর নিকট আরও নিকটবর্তী হতে পারি, তার রহমত ও মাগফিরাত লাভ করতে পারি। তাই রমজান মাসে সবাইকে সিয়াম পালনের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইবাদত ও ভালো কাজের দিকে মনোযোগী হতে হবে।