ইসলামি জীবনদর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো সাওম বা রোজা। এটি কেবল একটি ধর্মীয় ইবাদতই নয়, বরং আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের এক অমূল্য উপায়। রোজা মানুষের আত্মিক শুদ্ধি, পার্থিব বিষয়াবলি থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদন ও তাকওয়া অর্জনে এক অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। রোজার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার দৈনন্দিন জীবন থেকে সমস্ত ভোগবিলাস, খাবার-দাবার এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থেকে আত্মসংযমের শিক্ষা লাভ করেন। এভাবে, রোজা মানুষের মধ্যে নিজের আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার উন্নতি সাধন করতে সহায়তা করে।
এছাড়াও, রোজা শুধুমাত্র শারীরিক কষ্টের প্রতীক নয়, এটি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে এক প্রকার আত্মশুদ্ধির পথ। রোজা পালন করার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার ইচ্ছাশক্তি ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন এবং আল্লাহর কাছে আরো কাছাকাছি পৌঁছানোর এক অপূর্ব সুযোগ লাভ করেন। রোজার বিধান মূলত মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের জন্য প্রবর্তিত হয়েছে। এটি মুসলিম সমাজে আত্মসংযমের, ধৈর্যধারণের এবং সামাজিক সদ্ভাবনা বৃদ্ধির এক শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই, রোজা শুধু এক ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, এটি জীবনকে সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা যারা ইমান এনেছ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমনি করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। যেন তোমরা (রোজার মাধ্যমে) মুত্তাকি হতে পার। আল্লাহকে ভয় করতে পার (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)।’
আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা গোটা ইমানদারগণকে সতর্ক করেছেন, যেন তারা জাগতিক কাজকর্মে সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহকে ভয় করে। অর্থাৎ তাদের সমস্ত কাজকর্ম যেন ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক হয়, কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক হয় তথা আল্লাহর নির্দেশ এবং আল্লাহর রসুলের আদর্শ অনুযায়ী হয়। মহান আল্লাহর কাছে রোজাদারের মর্যাদা সীমাহীন। মহান আল্লাহ হাদিসে কুদসির মাধ্যমে বলেন, ‘রোজা আমার জন্য, এবং আমিই এর প্রতিদান দেব।’ প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাসের আগমন ঘটে তখন বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয় (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।’
কোরআন-হাদিসে রোজাদারদের সম্মানে এত কিছু বলার পরও কিছু কিছু মানুষের রোজা রাখা একদম মূল্যহীন হবে অর্থাৎ তাদের জন্য রোজা হবে শুধু না খেয়ে থাকা। নিচে তাদের বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
মিথ্যাবাদী : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং তা অনুসারে কার্যকলাপ করা পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করাতে (রোজা রাখাতে) আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য নেই (মিশকাতুল মাসাবিহ)।’
আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় বাধাদানকারী : পবিত্র আল-কোরআনে অতি স্পষ্টভাবে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় বাধাদানকারীদের বিষয়ে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেসব লোক আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তদনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না তারা কাফের (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৪)।’ সুতরাং আলোচ্য আয়াতের ভাষ্য অনুসারে কাফেরের রোজা রাখা আর না খেয়ে থাকা সমান।
নেশাকারী : নেশাকারীর বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘নেশাদ্রব্য পানকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না (সুনান আন-নাসাঈ)।’
পিতা–মাতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারকারী : মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পিতা-মাতা উভয়কে অথবা তাঁদের একজনকে বার্ধক্যে পাওয়ার পরও (তাদের সেবা করে) জান্নাত লাভ করতে পারল না, ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি।’ (সুনান আত-তিরমিজি ও সহিহ ইবনে হিব্বান)। আরেক বর্ণনায় আছে- রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, যে রমজান মাস পেল অথচ গুনাহ মাফ করাতে পারল না (সুনানে আত-তিরমিজি)।’
রোজা রাখার বিধান প্রবর্তনের অন্যতম কারণ হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়া অর্জন তথা আল্লাহভীতি। সুতরাং রোজা রেখে মহান আল্লাহর অপছন্দনীয় ও নিষেধাজ্ঞামূলক কাজ করা মহান আল্লাহর সঙ্গে ভণ্ডামি ও নাফরমানি করার শামিল। যেমন আর্থসামাজিক অসাধুতা, প্রতারণা, মিথ্যাচার, অশ্লীলতা, বেপর্দায় চলা, অন্যায়-অত্যাচার, অনাচার-পাপাচার, খুন-রাহাজানি, সন্ত্রাসবাদ, ব্যভিচার, মদ-জুয়া, সুদ-ঘুষ, অযথা কথা বলা, গিবত করা, পণ্যে ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, ধোঁকাবাজি করা, মজুতদারি ও কালোবাজারি, ব্যবসায় অধিক মুনাফা অর্জন, অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করা, দুর্নীতি করা, অপচয়-অপব্যয়, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালন না করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, অধীনস্থ কর্মচারীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, অধীনস্থ কর্মচারীর ওপর অযৌক্তিক কাজ চাপিয়ে দেওয়া, অবিচার করা, কারও মনে কষ্ট দেওয়া, নাচ-গান করা, হারাম উপার্জন করা সর্বোপরি পৃথিবীতে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করা ইত্যাদি।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, ‘এমন অনেক রোজাদার আছে যাদের রোজা দ্বারা শুধু পিপাসাই লাভ হয়, আর কতক এমন নামাজি আছে, যারা সারা রাত জেগে নফল নামাজ আদায় করে ঠিকই; কিন্তু তাদের নামাজ পড়া দ্বারা শুধু রাত জাগরণই হয় (মিশকাতুল মাসাবিহ)।’ রোজা কেবল না খেয়ে থাকার নাম নয়; বরং এটি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, সংযম ও তাকওয়ার এক মহান শিক্ষা।
ইসলামিক জীবনদর্শনে রোজা (সাওম) শুধু একটি শারীরিক কার্যকলাপ নয়, বরং এটি একজন মুসলিমের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও তাকওয়া অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে, রোজা রাখার সময় যদি কেউ শরিয়তবিরোধী কাজ করে, তাহলে তার রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা অব্যর্থভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেমন, যদি দুধে গোমূত্র মিশিয়ে দেওয়া হয়, তখন সে দুধ আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না, তেমনি শরিয়তবিরোধী কাজের কারণে রোজাও তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। ইসলাম কেবল কিছু নিয়ম মেনে চলার জন্য নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা মানুষের অন্তর, আচার-আচরণ, চিন্তা এবং কর্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করার নির্দেশনা দেয়। রোজা পালন করার মাধ্যমে শুধুমাত্র খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকা নয়, বরং খারাপ কাজ, মিথ্যা বলা, গিবত (গীবত বা পরনিন্দা), অশালীনতা এবং অন্য সকল ধরনের শরিয়তবিরোধী কাজ থেকেও বিরত থাকতে হয়।
তাহলে, রোজা যদি শারীরিক স্তরের বাইরে আত্মিক শুদ্ধি ও তাত্ত্বিক উন্নতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকে, তবে শরিয়তবিরোধী কাজ রোজার মূল উদ্দেশ্যকেই নষ্ট করে দেয়। তাই, ইসলাম শুধুমাত্র কিছু আদেশ পালন করার সুযোগ দেয় না, বরং এটি একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিম জীবনযাত্রার মূল দিকনির্দেশনাসমূহ প্রদান করে, যাতে ব্যক্তি এবং সমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও শুদ্ধতা সাধিত হয়।